আজ আমরা এমন কিছু ফিচার নিয়ে আলোচনা করবো যার সাহায্যে আপনি আপনার পরবর্তী পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসি কেনার সময় ভালোভাবে বিবেচনা করে নিতে পারবেন। এটা কোন পুঙ্খানুপুঙ্খ তালিকা নয়, তবে আপনাকে ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের পার্থক্যগুলো ভালোভাবে বুঝতে ও একটি স্মার্ট সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য
বহনযোগ্যতা
প্রতিটি কম্পিউটার এর পেছনেই বহনযোগ্যতা ও কর্মক্ষমতার মাঝে সমঝোতা করতে হয় – আপনি হয়ত খেয়াল করে থাকবেন যেই ল্যাপটপ অথবা ডেস্কটপ যত বড় হয় তার অভ্যন্তরীণ স্পেসিফিকেশনও তত বেশি আকর্ষণীয় হয়। আপনি যদি আপনার পিসি ও কাজ সবসময় আপনার সাথেই রাখতে চান তাহলে ল্যাপটপ আপনার জন্য সবচেয়ে ভালো।
ডেস্কটপ কম্পিউটার একেবারেই যে নাড়াচাড়া করা যায় না তা নয়, আপনি প্রয়োজনে এর কিছু পার্টস আলাদা করে অথবা পুরো সিপিইউ সাথে করে কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু বহনযোগ্যতা যদি আপনার প্রধান চাহিদা হয়ে থাকে তাহলে আপনার ল্যাপটপই কেনা উচিত। ডেস্কটপে উন্নত ইন্টারনেট স্পিড, উচ্চমানের কনফিগারেশন এবং তুলনামূলক ভালো অনলাইন ক্লাউড বা ড্রাইভ সুবিধা থাকে। এতে করে আপনার ভারিক্কি কাজগুলো শেষ করার জন্য অফিস-ঘন্টা শেষ হবার পর একা একা অফিসে বসে থাকার দরকার নেই, বরং সেই কাজ বাসায় বসেও আরাম করে নিজের ডেস্কটপে শেষ করা যায়।
পাওয়ার ও দাম
এটা খুবই স্বাভাবিক যে বেশি পাওয়ারের ও ভালো কনফিগারেশনের পিসি মানে হচ্ছে আপনাকে ভেতরে অনেক যায়গাবিশিষ্ট একটি বড় ডিভাইস কিনতে হবে। শুধু যে পার্টসগুলো বড়সড় তা নয়, অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া থেকে বাচানোর জন্য সেগুলোর আশেপাশে বাড়তি ফাকা যায়গাও থাকা জরুরি। যতক্ষণে একটি ল্যাপটপ ডেস্কটপ-লেভেলে পারফর্ম করতে শুরু করে, ততক্ষণে সেটা ল্যাগ খাওয়া শুরু হয়ে যায় ও অনেক শব্দ আর তাপ নির্গমন করতে থাকে। অতএব আপনার কাজে যদি সর্বোচ্চ পাওয়ার ও কর্মক্ষমতা আবশ্যক হয় তাহলে অবশ্যই ডেস্কটপ পিসি আপনার জন্য সেরা।
এছাড়াও একই দামের রেঞ্জে একটি ডেস্কটপ যেকোন ল্যাপটপকে স্পেসিফিকেশনের গুনাগুনের তালিকায় পেছনে ফেলে দেবে, হোক তা প্রসেসর, মেমোরি, লোকাল স্টোরেজ স্পেস, কিংবা গ্রাফিক্সের পাওয়ার, সম্প্রসারণের পোর্টসমূহ ইত্যাদি। একই সেরা পারফরমেন্সের ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যাপটপের পার্টসের অনেক বেশি দাম হয়, কেননা উপাদানগুলো অনেক ছোট হয় ও এগুলোর উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি। যদিও সবার এত বেশি পাওয়ারের কম্পিউটার দরকার হয় না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এধরনের অত্যাধুনিক ও পেশাদারী কম্পিটার ব্যবহার করেন গেমার ও ভিডিও এডিটররা।
স্ক্রিনের সাইজ
ল্যাপটপগুলিকে নিঃসন্দেহে এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে সেগুলো সহজে বহন করা যায়, সেজন্য তাদের সবকিছুই যথাসম্ভব ছোট রাখতে চেষ্টা করা হয়। দেখা যায় যে যেখানে ডেস্কটপের স্ক্রিন সাইজের রেঞ্জ শুরু হয় সেখানে তাদের স্ক্রিন সাইজের রেঞ্জ এসে থেমে যায়। বেশিরভাগ ল্যাপটপের ডিসপ্লে ১১” থেকে ১৫” হয়, যদিও মার্কেটে ২১ ইঞ্চি স্ক্রিনেরও ল্যাপটপ পাওয়া যায় তাদের জন্য যারা কোনভাবেই বড় স্ক্রিন ছাড়া কাজ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে ল্যাপটপগুলোও অনেক বড় হয় এবং অবশ্যই এগুলো বহন করা বেশ কষ্টকর হয়।
অপরদিকে, ডেস্কটপ মনিটরের সাইজ সাধারণত ১৭ ইঞ্চি বা তার চেয়েও বেশি হয়। এছাড়াও মার্কেটে অল-ইন-ওয়ান ডেস্কটপ পিসি রয়েছে, যেগুলোতে পুরো সিপিইউ, সাউন্ড সিস্টেম ও মনিটর একসাথে একটি ডিভাইস হিসেবে তৈরি করা হয়। এই পিসিগুলো দেখতে যেমন দারুণ, তেমনি আশেপাশে অনেক যায়গা বাঁচায়। আপনার যদি পাশাপাশি ২টা উইন্ডোতে ভিন্ন এপ্লিকেশন কিংবা একই এপ্লিকেশনের ২টা উইন্ডোর মধ্যে তুলনা করে কাজ করার প্রয়োজন হয়, অথবা ঘরে বসে দারুণ ফোর-কে ব্লু-রে মুভি উপভোগ করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে একটি ভালো সাইজের ডেস্কটপ মনিটর একটি ছোট মনিটরের ল্যাপটপের তুলনায় অবশ্যই অনেক পার্থক্য তৈরি করতে পারে।
পরিবর্তনের সুযোগ-সুবিধা
ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটারের আরো একটা বড় পার্থক্য হলো এর বিভিন্ন ধরনের কনফিগারেশন মিলিয়ে সেট-আপ করার সুবিধা। একটি ডেস্কটপ কম্পিউটারের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের পার্টস বাছাই করে কম্বিনেশন করার ভালো সুযোগ থাকে, যেমন- মেমোরি, প্রসেসর, মাদারবোর্ড ইত্যাদি। আপনি চাইলেই গোড়া থেকে আপনার মনের মত কনফিগারেশনের একটি পিসি তৈরি করে নিতে পারবেন – অগণিত কম্বিনেশন সম্ভব! এক্ষেত্রে আপনাকে নির্দিষ্ট পরিমান প্রযুক্তিগত বিদ্যা রপ্ত করে নিতে হবে। তারপরও তা ল্যাপটপের কনফিগারেশন তৈরি করার চেয়ে সহজ কেননা সেখানে সুযোগ সীমিত, আবার একটি হাল্কা বহনযোগ্য ল্যাপটপের বেশিরভাগ পার্টস নন-রিমুভাবল হয়ে থাকে।
স্পেস ও উত্তপ্ত হওয়ার সমস্যার জন্য একটি ল্যাপটপ অনেকটাই কমপ্যাক্ট সিস্টেমের মত – প্রতিটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যায়গা গুরুত্বপূর্ণ – তাই ভেতরের জিনিসপত্রের ক্ষেত্রে বাছাবাছির সুযোগ নেই বললেই চলে। এছাড়াও একই কারণে ল্যাপটপ আপগ্রেড ও মেরামত করাটাও বেশ ঝামেলার। হয়ত বেশিরভাগ মানুষই কনফিগারেশনের স্বল্পতা কিংবা মেরামতের অসুবিধাকে আমলে নাও নিতে পারে, কিন্তু একজন স্মার্ট ক্রেতা হিসেবে আপনার সিদ্ধান্ত নেবার আগে এই বিষয়টি ভেবে দেখা খুবই জরুরি।
স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব
অবশেষে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অঙ্গভঙ্গিমা বা বসার ভঙ্গি। এটি হয়ত অনেকের কাছেই তেমন গুরুত্ব পাবে না বা অনেকে এটা ভেবেও দেখবেন না, কিন্তু এক্সপার্টরা বলেন যে যে কারো পার্সোনাল কম্পিউটার ব্যবহারের সময় এর স্ক্রিন তার চোখের বরাবর বা আই-লেভেলে থাকা উচিত। ল্যাপটপ ব্যবহারের সময় এটা করা আসলে সম্ভব হয়ে ওঠে না, বেশিরভাগ মানুষই ল্যাপটপ ব্যবহারের সময় কুঁজো হয়ে বসেন ও তাদের ঘাড় ও পিঠ অস্বাভাবিকভাবে বাঁকিয়ে রাখেন।
আমরা এটা বলছি না যে আপনি আপনার ল্যাপটপ কোনকিছুর সাহায্যে উঁচু করে বসিয়ে স্বাস্থ্যকর ভঙ্গিমায় বসতে পারবেন না। কিন্তু ছোট ল্যাপটপের ক্ষেত্রে এই অবস্থানে বসার পর হাত ও হাতের কবজিতে অস্বস্তি অনুভব বা ব্যথা হতে পারে। অপরদিকে ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহারের সময় শরীর সোজা রেখে সুস্থভাবে বসা যায়, যেহেতু এতে মনিটর ও ইনপুট ডিভাইস যেমন কীবোর্ড, মাউস ইত্যাদি পৃথকভাবে থাকে এবং ইচ্ছামত পজিশনে রেখে কাজ করা যায়। অতএব আপনি যদি একটি ডেস্কটপ কেনার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দ্বিমতে ভুগে থাকেন, তবে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবশ্যই আপনার সিদ্ধান্ত পাকা করতে সাহায্য করবে।
ডেস্কটপ ব্যবহারের আরো কিছু ভালো কারণ
প্রতিটি পার্টস আলাদাভাবে আপগ্রেড করা সম্ভব, যা ল্যাপটপের তুলনায় অধিক সাশ্রয়ী
যখনই আপনি আপনার ল্যাপটপটি আপডেট করার কথা ভাবেন, হয় একসাথে অনেক কিছু কিনতে হয় অথবা একেবারে নতুন একটি ল্যাপটপ কিনে ফেলতে হয়, যা আপনার পকেটের ওপর বিশাল একটা ধাক্কার মতন। কারণ একটি ল্যাপটপের বেশিরভাগ পার্টসই একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত ও একটি পরিবর্তন করতে হলে অপরটিও পরিবর্তন করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ত শুধু প্রসেসরে সামান্য সমস্যা থাকে বা র্যাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয়, বাকি জিনিসগুলো ভালো থাকা সত্ত্বেও সেগুলো বাড়তি টাকা খরচ করে পরিবর্তন করতে হয়।
একটি ডেস্কটপের ক্ষেত্রে সামান্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকলে আপনি খুব সহজে একটি পুরনো কিংবা অচল প্রসেসর (এবং/অথবা মাদারবোর্ড) ল্যাপটপের তুলনায় কম টাকা খরচ করে পরিবর্তন করতে পারবেন। যদিও অল-ইন-ওয়ান ডেস্কটপ যেমন আইম্যাক নিজ হাতে আপগ্রেড করা কিছুটা ঝামেলাবহুল।
কষ্টের টাকায় পাচ্ছেন সবসময় একটু বেশি
একই স্পেসিফিকেশনের ডেস্কটপ ও ল্যাপটপ কখনো কখনো সমমূল্যের হয়, এটা সম্পূর্ণভাবে ব্র্যান্ডের উপর নির্ভরশীল। মূলত এই দুইয়ের স্পেসিফিকেশনের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো প্রসেসর ও গ্রাফিক্স।
ল্যাপটপে যেকোন প্রসেসরের ছোট ও বহনযোগ্য আকারের ভার্সন ব্যবহার করা হয়, যেগুলো ফুল-সাইজ ডেস্কটপের প্রসেসরের মত ততটা শক্তিশালী হয় না। যাদের পিসিতে উচ্চশক্তি ব্যবহারকারী কাজ করার প্রয়োজন হয় তাদের জন্য এই ব্যাপারটা মাথায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
হার্ডকোর গেমারদের জন্য ডেস্কটপই সেরা
গেমিং ল্যাপটপগুলো বেশ আকর্ষণীয় ও দারুণ হয়, কিন্তু এদের মধ্যে বেশিরভাগই বহন করার মত হয় না কেননা এগুলো অনেক বেশি ভারী ও আকারেও বড় হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো একটি পূর্ণাঙ্গ মাপের গেমিং ডেস্কটপের তুলনায় এই ল্যাপটপগুলো তেমন পারফর্মও করতে পারে না।
যেসব গেমাররা বহনযোগ্যতার চেয়ে পারফর্মেন্সকে গুরুত্ব দেন বেশি, তাদের জন্য ডেস্কটপের সমতূল্য আর কিছুই নেই। আর একই কনফিগারেশনের পিসি হিসেবে গেমিং ল্যাপটপের তুলনায় গেমিং ডেস্কটপে খরচও বেশ কম।
ডেস্কটপ থাকলেও একটি ল্যাপটপ ব্যবহার করা যায়, কিন্তু সেটা খুব বেশি দামী না হলেও চলে!
আপনার প্রধান ওয়ার্কস্টেশন হিসেবে একটি ভালো ডেস্কটপ থাকলে হালকা কিংবা বহনযোগ্য কাজের জন্য চাইলেই একটি কমদামী ল্যাপটপ অথবা ট্যাবলেট পিসি কিনে ফেলতে পারেন। এরকম একটি ল্যাপটপ আপনাকে যেকোন যায়গায় বসে আরাম করে ইন্টারনেট ব্রাউজিং, সোশ্যাল মিডিয়া ও ইউটিউব চালানো, এমনকি আপনার অ্যাসাইনমেন্ট অথবা প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে পারবেন ঘরের যেকোন কোনায় বসে। স্বল্পমূল্যের ল্যাপটপ যেমন ক্রোমবুক আপনার ডেস্কটপের পাশাপাশি এক দারুণ পরিপূরক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে, যেহেতু তাদের ওজন অনেক কম এবং আপনার বিভিন্ন হালকা কাজ সহজেই করে দিতে সক্ষম।
0 Comments